অবনীর বোধহয় অসস্থি লাগছে…

Post ID # 024

অবনীর বোধহয় অসস্থি লাগছে আমার পাশে বসতে। আমি যতটুকু পারা যায় রিক্সার সাইড ঘেষে বসে আছি। শুধু আড় চোখে অবনীর দিকে তাকানোর লোভ সামলাতে পারছি না। এই অবনীর সাথে ভার্সিটি লাইফের অবনীর কোনো মিল নেই। যার চোখে হাজারো পাগলামো খেলা করত, নিত্যনতুন দুষ্ট বুদ্বির আনাগোনা চোখ জলমল করে বেড়াত সেই অবনীর চোখ এখন নিষ্প্রাণ। চেহারায় গম্ভির প্রকৃতির একটা ভাব এসে পরেছে। নাকের ডগায় চশমা ঝুলানোর জন্যই অন্যরকম লাগছে। আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।

“আর একটু এইদিকে সরে আস। না হয় ঝাকুনি খেয়ে পরে যাবি”

নিরবতা ভেঙ্গে বলল অবনী। আমি পাশ ফিরে দেখলাম। সত্যি তো! আর একটু হলে রাস্তায় পরে যেতাম। আমি সরে বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান করে হাসল অবনী। তার হাসিতে সেই আগের উচ্ছাসটুকু নেই।

আমার মাথায় কখন থেকে একটি স্মূতি ঘুরছে। অবনীর সাথে শেষ দেখা হওয়ার কথা। ক্যাম্পাসের শেষ দিন ছিলো। গ্রেজুয়েশন শেষে মেতে উঠেছিলাম আনন্দ। প্লেনিং ছিলো আগেই। রিতিশাকে প্রোপোজ করার।

রিতিশা আমাদের ব্যাচেরই মেয়ে। রূপলাবন্য ভরপুর। ক্যাম্পাসে প্রথম দিন থেকে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। সেইদিন ৫ বছরের ভয়কে জয় করে ভালোবাসি বলেছিলাম। রিতিশা রাজি হয়ে গেল। অবনী এসে অভিনন্দন জানালো হেসে। সেইদিনের পর থেকে অবনীর দেখা মেলেনি। অনেক খোঁজার পরেও না। আজ হয়ে গেল নিউমার্কেটের সামনে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে দাড়িয়ে ছিলাম। বৃষ্টির দিনে রিক্সার অভাব, শেষে টুংটাং শব্দে পিছনে একটি রিক্সা থামল। অবনী বলায় উঠে বসলাম। এতটা বিষ্মিত ছিলাম কিছু বলার বা ভাবার কথা মাথায় আসেনি।

– কেমন আছিস রুদ্র?

অন্যদিকে তাকিয়ে বলল অবনী। আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি পরছে না এখন আর।

– চলছে হেলেদুলে। তুই তো হারিয়ে গিয়েছিলি একেবারে।

আমার কথায় আবার নিষ্প্রাণ হাসি অবনীর চেহারায়। কিছু বলল না অবনী। আমি চুপ হয়ে বসে থাকতে পারলাম না।

– তোর দিন কেমন যাচ্ছে?

অবনী এইবার ও চুপ। কেমন যেন বিষাদ ভর করেছে চোখে। রিক্সা থামালাম। আর একটু হাটলেই সিআরবি মোড়। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কত সময় কাটিয়েছি এই জায়গাটাতে। রিক্সা থামাতে দেখে ভুর কুচকে তাকালো অবনী। আমি তাকে নামার ইশরা করলাম।

পুরনো কিছু স্মৃতি এখনো রঙ্গিন হয়ে আছে। একবার ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে হুট করে বৃষ্টি নামল। সেইদিন ও পাশে ছিলো অবনী। দুজন সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছি। কখনো রিক্সায় কখনো হেটে। ঠান্ডায় কাঁপছিলাম দুজন। পাগলীটা ঐসময় হাতে আইসক্রিম ধরিয়ে দিলো। অবনীর কিছু হয়নি ঐদিনের বৃষ্টিতে ভেজার ফলে জ্বরে বিছানায় ছিলাম ৭ দিন। অবনী প্রায় ঐদিনটার কথা মনে করে হাসত।

সময়ের সাথে দুটো মানুষের অবস্থানের কত পরিবর্তন। অবনী হাটছে কিছুটা দূরত্ব নিয়েই। গুড়িগুড় বৃষ্টির ফোঁটা পরছে আবার।

– তুই এমন হয়ে গেলি কেন রে? _ না পেরে জিগেস করলাম।

– কেমন?

– তুই ভালো করেই জানিস অবনী।

– কোনো কিছু আগের মতো নেই রে। না তুই না আমি

গম্ভির হয়ে রইলাম। অবনী কথাটি বলে থেমে গেছে। প্রতিবাদ করে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। আমি তো বদলায় নিই। আগের মতোই আছি

– তুই বদলিয়েছিস অবনী। আমি না

– রুদ্র তুই বদলেছিস।

প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যাবো। অবনীর চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। আসলে কি বদলেছি?

ক্যাম্পাসের শেষ সময়টুকুতে এসে কিছুটা দূরুত্ব হয়ে গিয়েছিল অবনীর সাথে। সেটা অবশ্য রিতিশার মনোযোগ পাওয়ার জন্যই। তাই বলে বদলে তো যাই নিই।

– রিতিশা কেমন আছে রুদ্র?

হঠাত্‍ আমার দিকে তাকিয়ে বলল অবনী। চুপ হয়ে রইলাম। রিতিশার সাথে বেশিদিন সম্পর্ক টেকে নিই। প্রথম দিকে দুজনকে এক মনে হলেও পরে বুঝেছিলাম আমাদের ভাবনার জগতে বিস্তর তফাত।

– বড়জোর একবছর ছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও টেকেনি সম্পর্ক। আমার স্বপ্ন গুলো ছোট ছোট। রিতিশার স্বপ্ন আকাশ ছোয়া।

কথাগুলো বলেই থামলাম। পাশ ফিরতে খেয়াল করলাম অবনী তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম আমি।

– এখন একা একা ঘুরে বেড়ায়। মন্দ নেই। তোর খবর বল

আমার কখায় অবনী চুপ থাকে কিছুক্ষণ। আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। আজ অনেক স্মৃতি অনেক প্রশ্ন আসছে মাথায়। এসব রিতিশা চলে যাওয়ার পরেও এসেছিল।

– গ্রেজুয়েশন করে বের হওয়ার পর বাবা বিয়ে ঠিক করলেন। কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। মেলেনি ভাবনা গুলো। আজ আমাদের ডিবোর্স হলো।

অবনীর কথা শুনে চুপ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। হাটা শুরু করলাম আবার। কিছুদূর হেটে অবনী থামল। বৃষ্টির মাত্রা বেড়েছে ততক্ষণে। সামনে আইসক্রিম। অবনী আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। এই হাসি সেই ভার্সিটি লাইফে অবনীর হাসি !

একটা ছাউনির মাঝে দাড়িয়ে আছি আইসক্রিম হাতে। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। আশেপাশে পুরো জায়গা খালি। অবনী হাতের আইসক্রিম ফেলে ছুটলে বৃষ্টিতে। আমিও পিছু পিছু ছুটলাম। এই যেন সেই বছর ৫ এক আগের অবনী।

অবনী আকাশের দিকে তাকিয়ে ভিজছে। আমি তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টিতে। অবনীর চেহারায় কান্নাহাসির মিশ্রণ। যেন এক বৃষ্টিতে সব দুঃখ গুলো মুছে দিতে চাইছে !

সন্ধা নেমেছে । দুজন ভিজে চুপসে গেছি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবনী বলল

– রুদ্র , আমি হঠাত্‍ কেন হারিয়ে গেলাম জানতে চেয়েছিস?

অবনীর দিকে তাকালাম আমি। উত্তর নেই আমার কাছে

– রিতিশার সাথে তোর সম্পর্ক টিকবে না। আগে থেকেই জানতাম।

– বলিসনি কেন?

– বললে কি হতো? তুই মেনে নিতি?

আমি চুপ করে রইলাম।

– সেইদিন তোর জন্মদিন ছিলো। অন্যদিনের মতো আমার গিফট দেখেছিলি?

কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলাম। অবনী চোখে স্পষ্ট জল দেখছি। একটা গেইটের কাছে রিক্সা থামিয়ে নেমে পরলো অবনী। যাওয়ার আগে একটাবার ও তাকায় নি সে

পুরো রিক্সায় জুড়ে আমার প্রতি জন্মদিনে দেওয়া অবনীর সারপ্রাইজ গুলোর কথা মনে পরছে। চোখের সামনে ভেসে আসছে তার দেওয়া শেষ গিফটি। ডায়রী ছিলো সেটি। পড়া হয়নি। অস্থিরতা অনুভব করলাম। রিক্সা এত আস্তে চলছে কেন। অবনীর ডায়রীটি এখনো কি আগের জায়গায় আছে?

*

আমাকে নিয়ে প্রত্যেকটি স্বপ্নের কথা অবনীর ডায়রীতে সাজানো আছে। পাগলীটা বলেওনি একটাবার। সেইদিন সারারাত অস্থিরতায় কাটালাম। পরেরদিন ছুটলাম অবনীর বাসায়। ততক্ষণে অবনীর চলে গিয়েছে। বাড়ির কেউ বলেনি সে কথায়। সে হয়তো জানত আমি আসব তাকে ফিরাতে

অনেক সময় আমরা ভালবাসাকে খুব কাছ থেকে পেয়েও বুঝিনা ক্ষনিকের মোহের জন্য হারিয়ে ফেলি

— আশরাফ মামুন

Leave a comment